স্টার নিউজ বিদেশ ডেস্ক:
আফগানিস্তানে ২০ বছর কাটিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অবশেষে তারা দেশটি থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে পুরোপুরিভাবে। তাদের মিত্ররাও ধরেছে একই পথ। এ পরিস্থিতিতে অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছে তাদের হাতে গড়া আফগান সেনাবাহিনী। আত্মসমর্পণের হিড়িক পড়ে গেছে তাদের মধ্যে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে আফগান সেনাবাহিনীর পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান পুনর্গঠনে যত অর্থ ব্যয় করেছে, তার ৬০ শতাংশের বেশি খরচ করেছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই খাতে তাদের খরচ হয় প্রায় আট হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ বছরও অতিরিক্ত ৩৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আফগান সেনাবাহিনীকে। এত অর্থ ও সময় ব্যয় করে আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মিলিয়ে যে নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, তার সদস্য সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। একটি বিমান বাহিনীও তৈরি করেছে বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে দেশটি সবচেয়ে বেশি গর্ব অনুভব করে আফগান সেনাবাহিনীর কম্যান্ডো ইউনিটটি নিয়ে। কারণ এ বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ পেয়েছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু মার্কিন সেনারা দেশে ফেরত যেতেই এসব বাহিনীর প্রকৃত অবস্থা দেখা যাচ্ছে এবং সেই দৃশ্যটা খুবই করুণ। এমনকি পশ্চিমা মিডিয়ার বিভিন্ন খবরে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে আফগান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ কতটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে, তার বিবরণ। গণমাধ্যমের ওইসব খবরে বলা হচ্ছে, শত শত আফগান সেনা লড়াই না করেই তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ তুলে দিয়ে ইউনিফর্ম খুলে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় তারা তালেবান সদস্যদের সাথে কোলাকুলিও করে যাচ্ছে। অনেক সময় তালেবান যোদ্ধারা বড় ভাইয়ের মতো তাদের পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যেতে বলছে।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে-জেলায় তালেবানের অভিযানের পাশাপাশি আফগান সেনাদের এসব আত্মসমর্পণের ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় শহরের বাইরে যেসব সৈন্য বিভিন্ন ফাঁড়ি, তল্লাশি চৌকি পাহারা দিচ্ছে তারা আরো বেশি অসহায় বোধ করছে।
মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগগুলোও তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। ফাঁস হয়ে যাওয়া তাদের এক বিশ্লেষণে তাদের এ মনোভাব দেখা গেছে। সেখানে তারা বলছে, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন হতে পারে। অর্থাৎ কাবুলের সুরক্ষাতে আফগান সেনাবাহিনীর ওপরও তাদের পূর্ণ নির্ভরতা নেই।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের একজন সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ হোসেন বলেন, আফগান সেনাবাহিনীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পয়সা খরচ করেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছে এটা ঠিক, বিশেষ করে তাদের স্পেশাল ফোর্স বিভিন্ন সময়ে তালেবানের বিরুদ্ধে ভালোভাবেই লড়াই করেছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে, সে সময় মার্কিন সেনারা তাদের সাথে ছিল। তবে মার্কিন সেনারা চলে যাবার পর যে নতুন পরিস্থিতি তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য আফগান সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল না।
পাশাপাশি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ যে মাত্রায় প্রাণহানির শিকার হয়েছে তা যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মনোবলের জন্য খারাপ। ২০০১ সালে থেকে এ পর্যন্ত তালেবানের সাথে লড়াইয়ে যেখানে ৭ হাজার ন্যাটো সৈন্য মারা গেছে, সেখানে ২০০৭ সাল থেকে আফগান পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ৭৩ হাজার। এই মৃত্যুভীতিও তাদের মনে ভয় ধরিয়েছে।
সব মিলিয়ে এ অবস্থায় আফগান সেনাবাহিনীর মনোবল এতই তলানিতে নেমেছে যে, তারা নিজেরাই তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না। ফলে তাদের মধ্যে আত্মসমর্পণের হিড়িক লেগেছে।