মুসলিমদের কাছে জমজম কূপের পানি ‘অত্যন্ত পবিত্র’ এবং ‘অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন’

স্টার নিউজ প্রতিবেদন:
মুসলিমদের কাছে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত কাবাঘরের মাত্র ২০ মিটার দূরে মক্কায় মসজিদুল হারামের ভেতরে জমজম কূপটি অবস্থিত।
প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলিম হজ-ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে যান তাদের বেশির ভাগই জমজম কূপের পানি নিয়ে দেশে ফেরেন।
হজ পালন করে এসেছেন অথচ জমজম কূপের পানি আনেনি এমন মানুষ বেশ বিরল। তাদের প্রত্যাশা এই ‘পবিত্র পানি’ পান করলে বিপদ, রোগ কিংবা যে কোন অমঙ্গল দূর হবে। কিন্তু মুসলিমদের কাছে কেন জমজম কূপের পানি এতো গুরুত্বপূর্ণ ? সেটির কিছু ঐতিহাসিক দিক রয়েছে। ।
আমরা আজ জানব জমজম কূপের ইতিহাস:
হাজার হাজার বছর আগে নবী ইব্রাহিমের স্ত্রী হাজেরা ও ছেলে ইসমাইলের পানির তৃষ্ণা মেটানোর জন্য আল্লাহ এই কূপটি সৃষ্টি করেছিলেন।
কোরআনের সুরা ইব্রাহিমে এই কূপটি সৃষ্টির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম বুখারি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ৮৬০ সালে ছয় খণ্ডের হাদিস সংকলন করেন যেটি সহিহ আল বুখারি । সহিহ বুখারিতে এই কূপের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
এতে বলা হয়, ইব্রাহিম আল্লাহর নির্দেশে তার স্ত্রী হাজেরা এবং ছেলে ইসমাইলকে মক্কায় কাবা ঘরের কাছে নিয়ে যান। তখন মক্কা অনাবাদী মরুভূমি ছিল। সেখানে কোন মানুষ ছিল না, এমনকি পানির ব্যবস্থাও ছিল না। হাদিস-এর বর্ণনা মতে, আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তার উপর বিশ্বাস রেখে তাদের কিছু খেজুর ও পানি দিয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে রেখে চলে যান ইব্রাহিম। হাজেরা তার স্বামী নবী ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? “আমাদেরকে এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী আর না আছে কোন ব্যবস্থা। কিন্তু ইব্রাহিম তার দিকে তাকাননি”। সবশেষে হাজেরা প্রশ্ন করেন, এর আদেশ কি আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন? উত্তরে ইব্রাহিম হ্যা বললে ফিরে আসেন হাজেরা। তবে কয়েকদিনের মধ্যে তাদের এ খাবার শেষ হয়ে যায়। শিশু ইসমাইল পানির তৃষ্ণায় কান্না শুরু করে । তার মা হাজেরা পানির খোঁজে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন এবং একইসাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি পানির খোঁজে মরীয়া হয়ে দুই পাহাড় সাফা এবং মারওয়ায় সাতবার দৌড়াতে থাকেন। সহিহ আল বুখারি হাদিসে আরো বর্ণনা করা হয়েছে, মারওয়া পাহাড়ে একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা জিবরাইল পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করছিল তখন ঝর্ণার মতো পানি বের হতে লাগলো।
আরেকজন ফার্সি চিন্তাবিদ ও ইসলামিক ইমাম ইবনে জারির আল তাবারি তার লেখা ‘তারিখু তাবারি’ র প্রথম খণ্ডে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, হাজেরা যখন শিশু ইসমাইলের কাছে আসেন তখন সে তৃষ্ণায় পা দিয়ে মাটি সরাচ্ছিল। ফেরেশতা জিবরাইল হাজেরার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ইব্রাহিমের সন্তানের মা বলে পরিচয় দেন। এরপর ইসমাইল মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলে জমজমের পানি প্রবাহিত হয়। হাজেরা লক্ষ্য করেন যে স্থানে ইসমাইল আঘাত করছে সে স্থান থেকে পানি বের হচ্ছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করে তিনি ছেলে ইসমাইলকে পানি পান করান। হাজেরা তখন পানি শেষ হয়ে যায় কিনা এমন আশঙ্কা করেন। এ আশঙ্কায় এর চারদিকে বালি ও পাথর দিয়ে বাঁধ দেন। ইব্রাহিমের স্ত্রী ও সন্তানরা যখন মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত ও অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিলেন, তখন এই পানিই তাদের প্রাণে বাঁচিয়েছিল।
সৌদি আরবের জিওলজিক্যাল সার্ভের অধীনে একটি জমজম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জমজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে জম জম শব্দ-গুচ্ছ থেকে। এর অর্থ ‘প্রবাহ বন্ধ করা’। ঝর্ণার পানি ধরে রাখার জন্য পানি যাতে পড়ে না যায় তাই হাজেরা বারবার এই শব্দ উচ্চারণ করছিলেন। পরবর্তীতে ঝর্ণাটি একটি কূপে রূপান্তরিত হয়। আর জমজম কূপ নামকরণ করা হয়।
জমজমের এই পানি দেখেই জুরহুম গোত্রের একদল অধিবাসী সেখানে বসতি স্থাপন করে। কূপটিকে ঘিরে মরুভূমিতে চলাচলকারী কাফেলার জন্য বিশ্রামের জায়গায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে আল্লাহর ঘর হিসেবে পরিচিত কাবা ঘর পুনর্নির্মাণে ফিরে আসেন ইব্রাহিম। এটি মূলত ইসলামের প্রথম নবী আদমের সময় নির্মিত বলে বিশ্বাস করা হয়। মক্কা নগরী জনবসতিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম উপলক্ষ ছিল এই জমজম কূপটি। কাবাঘরটি এখন পবিত্র মসজিদ আল হারামের মধ্যে অবস্থিত। কাবাঘরের কাছে পূর্ব কোণে ২০ মিটার দুরে এই জমজম কূপটি অবস্থিত। ইতিহাসবিদরা বলছেন, আল্লাহর নির্দেশে অনুর্বর মরুভূমিতে ইব্রাহিম শিশুপুত্রসহ মা হাজেরাকে রেখে আসেন। এর উদ্দেশ্য হল এর মাধ্যমে মক্কা জায়গাটা আবাদ হবে, কাবাঘর পুনর্নির্মাণ হবে, জমজম চালু হবে, কাবাঘরে মানুষ হজ করতে আসবে। মূলত এই কৌশলের অংশ হিসেবে জমজম কূপের সৃষ্টি হয়।
মুসলিম ইতিহাসবিদ ইমাম তাবারানির ‘আল মুজামুল কাবির’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নবী মুহাম্মদ (সঃ) নিজেই জমজমের পানিকে শ্রেষ্ঠ পানি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন- “ জমজম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্য ও রোগ থেকে মুক্তি”।
কূপটির বৈশিষ্ট্য ও রক্ষণাবেক্ষণ;
‘সৌদি গেজেট’ সংবাদপত্র অনুযায়ী, জমজমের কূপটিকে বিশ্বের ‘প্রাচীনতম কূপ’ বলে ধারণা করা হয়। কারণ গত পাঁচ হাজার বছর ধরে এখান থেকে একটানা পানি পাওয়া যাচ্ছে। সৌদি আরবের জিওলজিক্যাল সার্ভে-র জমজম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার এই পানির কুয়োর মান, গভীরতা, অম্লতার মাত্রা বা তাপমাত্রার দিকে নিয়মিত নজর রাখে। জমজম স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ সেন্টার এই কূপের পানি সরবরাহ ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এটি মক্কা ও মদিনায় ফিল্টারিং ও স্টোরেজ প্ল্যান্টের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের গুনমানের নিশ্চয়তা বিধান করে।এটি ত্রিশ মিটার গভীর। তারপরেও এটি প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে আঠারো লিটার পানি পাম্প করতে পারে। আরব নিউজে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ৭০০ মিলিয়ন সৌদি মুদ্রা ব্যয় করে জমজম কূপের পানি উত্তোলন, তদারকি ও বিতরণ (কেপিজেড ডব্লিউ) প্রকল্প করেছে। মসজিদুল হারামের পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে কুদাই এর কেপিজেড ডব্লিউ প্ল্যান্টে ভূগর্ভস্থ পাইপের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয়। কুদাই থেকে মদিনার বাদশাহ আবদুল আজিজ সাবিল জলাধারে প্রতিদিন ট্যাঙ্কার ট্রাকের একটি বহর চার লাখ লিটার পর্যন্ত পানি পরিবহন করা হয়। এর ধারণক্ষমতা ১৬ হাজার ঘনমিটার। এখান থেকে মসজিদে নববীতে পানি সরবরাহ করা হয়। জমজম কূপ সৃষ্টির পর থেকে বালু ও পাথর দিয়ে ঘেরা ছিল। দড়ি এবং বালতি দিয়ে এই কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করা হতো।

খনন বা সংস্কার কাজ ; জুরহুম গোত্র সেখানে বসতি গড়ার পর ইসমাইল সেই গোত্রের এক নারীকে বিয়ে করেন। একটা সময় এই গোত্র অন্যদের এই কূপের পানি ব্যবহারে বাধা দিলে মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। পরে একটা সময় ময়লায় আবদ্ধ হয়ে এই কূপটি অব্যবহৃত ও অনাবিষ্কৃত থাকে বলে ইসলামের ইতিহাস গবেষকরা বলেন। পরবর্তীতে নবী মুহাম্মদ (সঃ) দাদা আব্দুল মুত্তালিব দীর্ঘদিন এই কূপের সন্ধান করেও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে তিনি স্বপ্নে এর সন্ধান পান। রাসুলের (সঃ) দাদা আব্দুল মুত্তালিব দীর্ঘদিন খুঁজেও পাচ্ছিলেন না। একদিন তাকে স্বপ্নে দেখানো হলো প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিলে এর সন্ধান দেয়া হবে। তার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল রাসুলের বাবা আব্দুল্লাহ। তার অন্য ছেলেরা এই ছেলেকে কোরবানি দিতে নিষেধ করে, ১০০ উট কোরবানি দেয়ার কথা বলে। এরপর ১০০ উট কোরবানি দেয়ার কথা বললে আল্লাহ আবার জমজম কূপের পানি বের হওয়ার নির্দেশ দেন। সেই থেকে এটির পানির প্রবাহ হাজার হাজার বছর ধরে চলছে।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। এটিতে বলা হয়েছে, সে সময় মক্কা ছিল জুরহুম গোত্রের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের পাপের কারণে তাদের উপর অভিশাপ নেমে আসে। হারিয়ে যায় জমজম কুয়া। ফলে তারা মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
নবী মুহাম্মদ (সঃ) দাদা মুত্তালিব পরবর্তীতে স্বপ্নে পেয়ে এটি পুনরায় আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে এটির অস্তিত্ব বহমান ছিল। কারণ তখন মুহাম্মদ (সঃ) মক্কায় ইসলামের অভয়ারণ্য তৈরি করেছিলেন। পরে সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে কূপটির ব্যাপক সংস্কার করে।হজ পালনের কোন প্রক্রিয়ার সাথে জমজম কূপের পানির কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে ইসলামি চিন্তাবিদরা বলেন, হজ পালনের সময় এটি একটি অনুষঙ্গ মাত্র। কিন্তু হজ পালনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। হজ্জের ইতিহাসের সাথে জমজমের সম্পর্ক রয়েছে।সৌদি আরব থেকে পর্যটকরা পানি পরিবহন করতে পারলেও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রপ্তানি করা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ২০২০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, জমজম কুয়ার পানি রোগ-জীবাণুমুক্ত। এই পানিতে সিরাম ইউরিক এসিড স্বাভাবিক মাত্রার চেয়েও কম বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। একইসাথে এটি লিভারের জন্যও নিরাপদ। মানব স্বাস্থ্যের জন্য এই কুয়ার পানি নিরাপদ এবং উপকারী প্রভাব রয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। একই ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে জমজমের পানি নিয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পানির আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে সব প্যারামিটার সঠিক মাত্রায় রয়েছে জমজমের পানিতে। এতে গ্রহণযোগ্য রাসায়নিক প্রোফাইল রয়েছে বলে বলা হয়েছে। তবে, আরো বৃহত্তর গবেষণা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।