
একরামুল কাইছার ::
দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে দরকার একটি আদর্শিক রাজনৈতিক দল। যেটার অভাবের কারণে মানুষ গত ৫৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ বিএনপির মত স্বৈরাচারী দলকেই বারবার জেনেশুনে ভোট দিয়ে এসেছে। এসব দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর ভুলে যায় জনসাধারণকে, গোছাতে থাকে নিজেদের আখের, হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি একটি আদর্শিক নতুন রাজনৈতিক দল। গণ মানুষের সেই আশা আকাঙ্খা পূরণে দেশ বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করতে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের সব আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে আগামী শুক্রবার বিকেল ৩টায় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে।
দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে সেদিন ১ লক্ষ মানুষকে জড়ো করার লক্ষ্য রয়েছে রাজনৈতিক দলটির । ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলটির আহ্বায়ক কমিটির কথা জানিয়ে দেওয়া হবে। নিজেদের ফোরামে আলাপ-আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতেই নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে দলটির । আগামীতে দলের কাউন্সিলে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচিত করা হবে। যদিও গত কয়েকদিন থেকে শীর্ষ পদগুলো নিয়ে নানা মতানৈক্য চলছে দলটিতে। সেইসব শীর্ষ পদগুলো নিয়ে বিভেদের এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। যাদের নিয়ে মতানৈক্য চলছে তাদের মধ্যে আখতার হোসেন, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, আলী আহসান জুনায়েদ, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহর নাম রয়েছে। জানা যায়, রোববার রাতে একজন ছাত্র উপদেষ্টার বাসায় এক অভ্যন্তরীণ সভায় নাহিদ ইসলামের পরিবর্তে মাহফুজ আলমকে দলের প্রধান করার একটি প্রস্তাব ওঠে। তবে সেটি গৃহীত হয়নি। নাহিদ ইসলামেরই দলের প্রধান হওয়ার পক্ষে পাল্লা ভারী। এ ছাড়া প্রতিদিনই সভা হচ্ছে। দলের নেতারা বলছেন, নব্বই ভাগ নিশ্চিত নাহিদ দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন।

এদিকে নতুন দলের দায়িত্ব নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন। মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যমুনার বাইরে নিজ মুখে পদত্যাগের কথা জানান। পদত্যাগের পর পতাকা ছাড়া গাড়িতে চড়ে ফিরেছেন নাহিদ ইসলাম। পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় নিজের ফেসবুক প্রফাইলের ছবি পরিবর্তন করেন। সেখানে নিজ হাতে পতাকা উঁচু করে ছাত্রদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেন এবং লেখেন ‘জনতাই বৈধতা’।
রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশের দিন দলের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখ্য সংগঠক, মুখপাত্র, যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সদস্য সচিব এই আকারে হবে। এখন পর্যন্ত কাউকে বাদ রাখার কথা ভাবা হয়নি। বিরোধে আলোচনায় থাকা সবাই দলে স্থান পাবেন। তবে শীর্ষ পদে নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনের থাকার সম্ভাবনা বেশি।
এরপর হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম থাকবেন। এ ছাড়া অন্য পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সারোয়ার তুষার, আরিফুল ইসলাম আদীব, ডা. তাসনীম জারা, আলী আহসান জুনায়েদ, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ, মনিরা শারমীন, এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, মোল্লা ফারুক এহসান, সামান্তা শারমিন, ডা. মাহমুদা মিতু, অনিক রায়, আকরাম হুসাইন, আলী নাছের খান, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালেহ উদ্দীন সিফাত দলে অন্তর্ভুক্ত হবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, আবদুল হান্নান মাসউদ, সমন্বয়ক তারেকুল ইসলাম, নুসরাত তাবাসসুম, উমামা ফাতেমা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আসাদ বিন রনি অন্তর্ভুক্ত হবেন।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এ ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবার, দেশি-বিদেশি কূটনীতিকরা থাকবেন। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ থাকবেন। সবার উপস্থিতিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জনমত জরিপে অর্ধলাখ মানুষের অংশগ্রহণ-
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ নামে ইতোমধ্যে একটি জনমত জরিপ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। জরিপে অনলাইনে দুই লক্ষাধিক ও অফলাইনে ৫০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। জরিপের ফল তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা মানুষের কাছে জানতে চেয়েছি, কোন তিনটি কাজ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টে যাবে। নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের প্রত্যাশা কী, দলের নাম ও প্রতীক কী হতে পারে– তা আমরা জানতে চেয়েছি।
সদস্য সচিব আরো বলেন, অধিকাংশ মানুষ বলেছে, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে এবং দুর্নীতিকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ ও জবাবদিহি নিশ্চিতের কথা বলেছেন। সামাজিক ন্যায়বিচার ও সবার জন্য সমান সুবিধা তৈরি করা, সব ধরনের বৈষম্য নিরসন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বোপরি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের সেবার মান উন্নয়ন ও জনবান্ধব করার কথা বলেছেন। আমরা রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশার জায়গাগুলো পূরণের চেষ্টা করব।
এছাড়া দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে সততা ও আদর্শের কথা জোর দিতে বলেছেন মানুষ। একনায়কতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার কথা এসেছে জরিপে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা, রাজনৈতিক দলে তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলেছেন তারা। সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও মাফিয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন রাজনৈতিক দল ভূমিকা রাখবে বলে মানুষ প্রত্যাশা করেছে। আমরা ৩০টির মতো নাম পেয়েছি ঘুরেফিরে। দল আত্মপ্রকাশের আগেই এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি নাম চূড়ান্ত করা হবে। দলের প্রতীকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংগ্রাম, উন্নয়ন ও ঐক্যের প্রতীকগুলোর প্রস্তাব এসেছে।

যে প্রেক্ষাপটে নতুন দল-
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতিভূ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার পর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরে জনগণের মনে সে রকম নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তবে ছাত্র-জনতা ঔপনিবেশিক শোষণমূলক শাসনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা দেখতে চায় না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে, তরুণরা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করবে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করবে নতুন রাজনৈতিক দল।