জয়ন্ত জিল্লুর কবিতা ; মায়ের আঁচল জড়ানো নন্দিত লোবান -নাসিমা হক মুক্তা

যে কবিতায় মায়ের মুখ কথা বলে
সে কবি শব্দে-বাক্যে – ছন্দের ফুল ফোটায়
নন্দিত লোবান মিশ্রিত আঁচল তলে- সে চিরকাল ঘুমায়।

কেন বলতে পারেন – মায়ের আঁচল তল নন্দিত লোবান? প্রশ্নটি করেছি – পাঠকদের।উত্তর – পাঠের ভেতর অর্ন্তনিহিত।যার কবিতায় – কাব্যের সুষমা ও উপকরণের মায়ের মুখ বারবার উজ্জ্বল। তাঁকে কবিতা সৃষ্টির সন্তান নয়, মায়ের সন্তান বলায় উচিত। এ সন্তান হচ্ছে জয়ন্ত জিল্লু। কবিতার চেয়ে মায়ের অনুরাগ যার বেশি।তাঁকে তো সালামসহ শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।হ্যা, কবি জয়ন্ত জিল্লু বয়সের মৃত্তিকার কাঁচা আবরণ হলেও মেধা, মনন ও সৃজনে শক্তপোক্ত ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর। শব্দ ও সৃজনশৈলীতা তাঁর মজ্জাগত অভিভাবক। পার্থিব ও অপার্থিব জগতদর্শন অনুভূতির জঠর খুদাই করা বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতি, মানুষ ও কবির অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি উন্নত ও নরম পলির মত। গাণিতিক বিশ্লেষণ ধারাপাতে ভগ্নাংশ – লব ও হরের সামষ্টিক প্রক্রিয়ার মত – কবির কবিতা নিপূন হাতের কষা শব্দ, কলা ও চিত্র অংক। যা তাঁর প্রতিটি কাব্য ও লেখায় চমৎকার অতিইন্দ্রিয়ের গহীনচরে আত্মিক বন্ধন। তাই তো কবির লেখার চিত্র, চরিত্র ও ঘটনাবলি – অভিজ্ঞতার বিবিধ রূপ যেন সহজাত প্রতিভা।সেজন্য তো তাঁর পাঁচ আঙল হস্তে কলমের কালি – তুলে এনেছেন শিল্প ও জীবন রদবদল। মনে পড়ে কি বিখ্যাত অনুকবিতা, ‘ নিউট্রন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না ‘ লেখক কবি হেলাল হাফিজ স্বল্প কাব্যগ্রন্থে চির অবিনশ্বর কবিতার জনক। যুগে যুগে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সবদেশে পরিচিত। তিনি বয়সে পৌঢ় কিন্ত কাব্যে নতুনে- যৌবনে ভরপর। আমার মনে হয়েছে – তাঁর সমতুল্য নয়, জয়ন্ত জিল্লুর কাব্যস্বাতন্ত্র্যে একটি মিল পাওয়া যায়। এখন বলি – এই যে কবি হেলাল হাফিজকে কেন টেনেছি তা – আমার পড়ার বিশ্লেষণ, চেতন- মননে ও অন্তঃপুরের চুরচুর ভাঙনে – কবি জয়ন্ত জিল্লু জলের উপর ভাসমান পদ্মফুল। যা দেখতে চিরকাল মধুর লাগে। তাঁর কবিতার অলংকার ও কাব্যে- গল্পে সংখ্যা কম হলেও সৃষ্ট- সাহিত্যে তাঁর নাম পদ্মফুলের জায়গা দখল করেছে। কিন্ত কথা হল- কারা তাঁকে এই আসীনে বসাবেন। যেমন – যাদের জহুরী চোখ, মায়ের পবিত্র মুখ, জীবন-যাপনে সাদামাঠা, সংবেদনশীলতা ও নান্দনিক মন, তারায়।
এবার একটি ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলি -কবি জয়ন্ত জিল্লুকে পত্রিকায় প্রকাশিত কাব্যে যতটুকু পড়েছি, কাব্যগ্রন্থে আমার তেমন জানা ছিল না। তাঁকে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করানোর জন্য – কবি প্রদীপ প্রোজ্জ্বলের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। কারণ আমি পাঠে বিশ্বাসী, পরিচয়ে নয়। যারা পাঠক তারা আবিষ্কার করেন – কবি ও কবিতার জনককে। স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে কাব্যের সৌন্দর্য একটু হলেও উহ্য থাকে, যা কাব্যিক পাঠে আলাদা রসবোধ জাগায়। তিনি একাধারে কাব্যিক, গল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ মানসপুত্রে সাহিত্যে ধরা দিয়েছেন। তাঁকে পাঠের অভিজ্ঞতা যার আছে তিনিই – বুঝতে পারবেন কতটুকু ভাষা গঠনে সরস, পুষ্ট ও সৃষ্ট। চলুন এবার কবির প্রকাশিত বই নিয়ে কিছু আওড়ায়। এই পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বই –
৩ টি কাব্যগ্রন্থ:
১: পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না ( ২০১৪)
২: ক্যালেন্ডার সিরিজ ( ২০১৭)
৩: সাকিয়া সিরিজ ( ২০১৮)

১ টি গল্পগ্রন্থ:
ছায়াশরীরের গল্প ( ২০১৫)

২ টি শিশুতোষ:
১: আকাশ চোরের নেইকো বিচার ( ২০২০)
২: আনজুমান ( ২০২০)
এবং
উপন্যাস:
কাচপোকার সংসার
এবার চলুন – তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না ( ২০১৪) : ক্যালেন্ডার সিরিজ ( ২০১৭): সাকিয়া সিরিজ ( ২০১৮) গুলো নিয়ে আবেগ, বাক্য, অনুভূতির বিনিসুতোই গাঁথি নক্শীকাঁথা। কবি তাঁর কবিতার কাব্যে সহজ, ভাবে গভীর। সেই সহজিয়া পথ ধরে আমি হাঁটতে হাঁটতে কবিকে খুঁজে – গ্রাম প্রতিবেশী হিসেবে। তখন চমকে উঠিতেছি। ভাবনায় মেতেছি – মগ্নচৈতন্যে। কারণ ঐ যে গ্রাম নোনাজল খাওয়া মানুষ আত্মাও যে – এতো পুষ্ট হয়, মাটিকামড়ানো ঠোঁট এতো আবেগী হয় ও চাষাভুষা জমিনপালে মায়ের মুখ আদল যে – ভাত ফোটায় তার কাব্যে ফুটে উঠেছে। কেন বলতে পারেন – কবি জয়ন্ত জিল্লুর লেখা শিরোনামে -মায়ের আঁচল তল নন্দিত লোবান আখ্যা দিয়েছি? কাব্যের সুষমা ও উপকরণের যে কবিতায় মায়ের মুখ পদে পদে মরু ও শুষ্ক ভাষা – বাক্যে উর্বরতা আনে, সেটি তো পৃথিবীর একমাত্র মা স্তুনপূষ্ট দেহ- মন ছাড়া এ জগতে আর কেউ পারে না। কবির ভেতরকার আহাজারি আমাকে জলে গলিয়েছে। একজন নাড়ীছেঁড়া ধন ছাড়া এমন বাক্যালাপ, পাগলামি ও ভেতরকার আত্মালাপ কেউ করতে পারে না। জন্মসৃষ্টি যেমন মায়ের আকর তেমনি কবির লেখাও মত মায়ের মুখ।সত্যি আমি যতটুকু মনে হেসেছি ততটুকু চোখের জলে কেঁদেছি। মনে হল – তিনি আমার পরম কুটুম। এই চলমানে – নবীনকে ছাড়িয়ে প্রবীণের দোয়া- বরকত হোক।

শুনুন – অমোঘ এই আধুনিকতার আটকানো জালে – মানুষ যে কত অশ্লীল, অসভ্য ও আদিমতায় ছাইভস্ম। তা নিজের বুননে সেজেছেন। মানব সমাজ এখন হাত বাড়াইলে যে – মানুষ ধরতে পারে না, ছুঁতে পারে না এবং কাপড়হীন মুখোশ খুব সুক্ষভাবে লিখেছেন। কবির ভেতর মানুষ গোঁড়ামি আত্মাভিমান বেশ পরখ করেছি। সমকালীন যে সমাজজীবন ব্যভিচার, বিবেকহীনতা, অন্ধত্ব, উদার-মানবতাহীন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তা ভাবনার বিষয়। আগামী দিনগুজরানো নারী- পুরুষ ও মানুষের সম্পর্কে দৃষ্টিহীনতার স্থির। তাও কবির কাব্যে- বাক্যে মনস্তত্ত্বে বিদ্যমান।হয়ত অনেকে ( “লা রোশফুকোর একটি ম্যাক্সিমে আছে – বই- এর চেয়ে মানুষকে পাঠ করা অনেক বেশী জরুরী ‘) পড়েছেন। আসলে মানুষকে কি আজ পর্যন্ত কেউ শতভাগ মানুষকে উদ্দার করতে পেরেছে? তা পারেনি। কারণ মানুষের পাশাপাশি মানুষ দূর- আত্মা,বড় বিচিত্র তার রং, রূপ তার বদলের হাওয়ার মত। মানুষ মানুষের জন্য অশ্লীল, ভঙ্গুর ও ধ্বংসের ছাই। তাই কবি জয়ন্ত জিল্লু তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ” পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না ( ২০১৪) কাব্যে বলেছেন –
মানুষ শব্দটাই অশ্লীল! এই যেমন মানুষ বলতেই কেমন করে ভয় দেখাতে উঠে এলো চোখ। তারপর কিল- ঘুষি দেখালো হাত। মাড়িয়ে দেবে, বলে গেলো পা। মুখ বলে গেলে, অনেক গালি দেবে। এই যেমন মানুষ বলতেই পেলাম মেরে ফেলার হুমকি।মাকে ধরে দিয়ে গেলো গালি। অবশেষে মানুষ বলতে দেখলাম, টপলেস কিছু মানবী আমাকে অন্ধ হতে বলে চলে গেলো।
( মানুষ শব্দটাই অশ্লীল / পৃ/২০)
কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে “পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না ” সাহিত্যে জাতে উঠেছেন, ছক্কা হেঁকেছেন ও সম্ভাবনাময়ী কবি প্রতিভায় জায়গা দখল করেছেন – অনেকের চেয়ে অগ্রসর লেখক হিসেবে পুঁতেছেন – বটবৃক্ষ! একাব্য গ্রন্থটি মানবতার ভেতরকার দমের বেদনা, আফসোস ও অসহ্য যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন। কারণ শিশুরা স্বর্গীয় আত্মার রূপ। তাই কবি বলতে চেয়েছেন, শিশুরা যেন মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় স্বীকার না হয়। বস্তু জগতের সমস্ত সংশয়, বিচ্ছিন্নতা ও দাঙ্গার থেকে মুক্ত থাকুক। যেমন- ফিলিস্তিনের শিশুদের নিয়ে বা ঐ দেশে মানুষের জুলুম – নিপীড়নের কাব্যরূপ, তাঁর প্রতিবাদী ভাষা, আমেরিকা ও জাতিসংঘের প্রতি ধিক্কার তথা মানবতা লণ্ঠনের প্রশ্নে ছুঁড়েছেন। শেষপর্যন্ত নিজের বিবেককে দমিয়ে – সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলেছেন – প্রার্থনায়। এধরনের কবিতা পড়ে – আমিও নড়েছি, দমেছি, ভেবেছি যে – কবি জয়ন্ত জিল্লু মানুষ না মানবী। সেটির উত্তর পাঠকের জন্য রেখেছি। ” পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না ” নাম শিরোনামের কাব্যটিও বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কবিতাটি এমন –

পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না
খালি আমার দুই পা দেখি
চটি- পড়া পায়ের তালু দেখি
ছাল – ওঠা মুখ দেখি
দাঁড়াবার মাটি দেখি না ( প্রথমাংশ/ পৃ/২৯)

এধরনের ভাবগাম্ভীর্য, দেশাত্মবোধ, মমত্ববোধ ও প্রেমবোধ সহ ভিন্নভিন্ন উপমায় এঁকেছেন- তাঁর মনের ভাব। ” “প্রেমের রুবাই ” এক, দুই ও তিনটি অনুকবিতা কবিতা পড়লে বুঝা যায় – প্রেম, মন, অনুভূতি ও মানুষ এরা কতটুকু পরস্পরের অঙ্গাবরণ। আরেকটি কবিতার অনু বীজ – পড়ুন-
” তুমি মুখ এঁকে দিতে বললে
আমি এঁকে দিলাম চাঁদ।
সেই থেকে তুমি কলঙ্ক বয়ে বেড়াও।
( কলঙ্ক /পৃ/ ৩৯)
এ কাব্যগ্রন্থে ৩৬ টি কবিতার বসত। প্রতিটি ছন্দে, মিলে,স্তবকে ও রূপকে দারুণ ব্যঞ্জনা।পাঠকের নিবিষ্ট কুঞ্জে প্রাণবায়ু সঞ্চারের শীতল অভিমুখ। আশ্চর্য রকম স্পর্শে সংযত লেখার কৌশলগত নীতি বারবার পাঠাভ্যাসে – যে কোনো পাঠককে তৃষ্ণা নিবারণের ডুক গেলানোর মত। বইটির প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুআরি ২০১৪, দ্বিতীয় মুদ্রণ : ফেব্রুআরি ২০১৭। প্রকাশক : আলী প্রয়াস, তৃতীয় চোখ। এটি উৎসর্গ করেছেন – তাঁর মা ও বাবাকে ( যে দুজনের সৌসুম আত্মসাৎ করে চলছি প্রতিনিয়ত)।

আমি বুঝি – কবিতা আত্মার অবিনশ্বর চেতনা।যা মানুষের অনুভূতি সজীব রাখে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশু সত্তার বিকাশ ঘটে। নানাবিধ চিন্তা, কল্পনা ও মনের গভীর অঞ্চলে আবাস পাতে। সেখানে মাঝেমাঝে ছোট – বড় ও মাঝারি আবেগ উদ্বেলিত হয়। কবি জয়ন্ত জিল্লু তাঁর কাব্যগ্রন্থ ” ক্যালেন্ডার সিরিজ” এমন কিছু ছোট ছোট পঙক্তি ব্যবহার করেছেন যা পড়তে জগতসম অনুভূতির জোয়ার উঠে মনে। ছোট বা অনু কবিতা সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যময় ধাঁধাঁ। শুধু অনুভূতিকে চরিত্রায়ন করে নানামাত্রিক ছন্দে। সেন্স অব হিউমারে সেসব কবিতা দারুণ ভাবে – গিটারবাদকের মত বাজায়।বহু অসমঞ্জস, অর্থনৈতিক লোভ, ভোগবাদীর স্বার্থপরতা ও সামাজিক শিষ্টাচার বর্জিত সমাজের অবরুদ্ধের ভাবমূর্তি প্রকাশ করে। যেমন –

ক্যালেন্ডারে স্তন আঁকা নিষেধ
স্তনের পাশে শিশুর ঘুমোতে যাওয়া নিষেধ
অথচ, আমরা
প্রতিটি সন্তান জানি-
স্তন কোনো অশ্লীল শব্দ না! ( অশ্লীল / পৃ/২৭(
আরেকটি অনু কবিতার ভাব ও অর্থ বুঝতে চেষ্টা করুন।”শাড়ি ” ছোট হলেও তার গভীরতা ভূপৃষ্ঠের তল ছুয়েছে।
আপনি কি নাভির নিচে শাড়ি পরেন?
না ভাই,আমি পুরুষের চোোখে শাড়ি পরি!
( শাড়ি/পৃ/ ২৬)

এ কাব্যগ্রন্থে কবি তাঁর “স্তনবিদ্যা ” কবিতায় একজন নারী যে উঁচু পাহাড় ধারণ করে তা নয়।একেবারেই ভিন্ন চিত্রকল্পে – মায়ের রক্তচোষা মানুষ পালনের বৃত্তটি যে – শুধু দেখার জন্য নয়, খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার দরকার। তা র নির্মম ও সত্য তুলে ধরেছেন। পুরো কবিতার সমষ্টি – মূল – আদিম লোলুপতাকে ছাড়িয়ে নারী, মা ও মাতৃত্বের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।জগতসম মায়া ও স্বর্গীয় শক্তি অনবদ্য সৃষ্টি এ কাব্যটি। প্রকৃতির পবিত্র পরশের অন্তরীক্ষে যে উজ্জ্বল মানব ও নারী সৃষ্টি, তার সুতীব্র দর্শন ” স্তনবিদ্যা ” কবিতার কল্পনার রং…..

বিন্দু একটি ধারণা। বিন্দুর বাইরে একটি বৃত্ত। বৃত্তের ভেতরে অসংখ্য তারিখ।গোপন জামা শুকাতে দেওয়া দুপুর,বিন্দুর অতীত। প্যাডেলে পা জমা দেওয়া সাইকেল একটি স্মৃতি,বৃত্তের ভেতরে। বাইরে মেঘ কালো, মা শুকাতে দেওয়া জামা কুড়িয়ে আনে। সংসারধর্ম বিন্দুর বাইরে, বাবা ভাত- বাসন ছেড়ে রাগ করে উঠে পড়ে, এটা বৃত্তের ভেতরে। ঘুম হয় না, বিন্দু থেকে বিঘত দূরত্বে। অন্ধকার একটি বৃত্ত। চাকায় পরিমাপ হওয়া রাস্তা, বিন্দুর সমষ্টি। ক্যালেন্ডার, সাল ও তারিখ বৃত্তের ভেতরে। প্রেম, প্রেমিকা ও, বিন্দু থেকে শুরু। বিন্দুর গোল চক্কর, স্তন। লাবণ্য স্তনের রূপ : বৃত্তের ভেতরে। ঘুম,জীবন ও বেড়ে ওঠা, স্তনবিদ্যা। এই স্তনবিদ্যা থেকে থেকে আমি তিনটি বিষয় শিখি- বিন্দু, বৃত্ত ও মাতৃত্ব।
( স্তনবিদ্যা/১৫)

জয়ন্ত জিল্লু কাব্যগ্রন্থ – ক্যালেন্ডার সিরিজ” প্রকাশিত হয়েছে – ফেব্রুআরি ২০১৭ / প্রকাশনা : চন্দ্রবিন্দু। এই কাব্যটি উৎসর্গ করেছে – সামিরা সাফা, বিস্তর পরাণের পালের হাওয়াকে। তাঁর প্রতিটি শব্দে – বাক্যে আলাদা স্টাইল ও ঢঙের দোলনা – অন্যকে অনুসরণ ও অনুকরণ করেন না। এই কাব্যের ভেতর ক্যালেন্ডার উপমায় বিশেষ জায়গা দখল করেছে। কবির বিস্তর পরাণের চেতনায়- প্রেম, মায়া, দুঃখ দহন থেকে শুরু শৈশব, সবুজ বৃক্ষ, মৃত্যু, পাখপাখালি, নদী- পাহাড় ও আয়ু ইত্যাদির উপমা বা নাম শিরোনাম কথা- কাব্যে – কল্পে সেজেছেন। এই গ্রন্থে প্রায় ৪০ টি কাব্যের বাস। এখন থেকে বেশকিছু পাঠককে খুব ভাবাবে। যেমন – টু ফিঙ্গার টেস্ট। মূলত কবিতাটি চিত্রায়িত হয়ে – ধর্ষণ নিয়ে। আসলে এই বিষয়টি মহামারি আকারে – ছড়িয়ে – কত অসহায় নারীর জন্ম যতিচিহ্নে দীর্ঘশ্বাস জমেছে, তা একমাত্র ঐ সতিত্ব হারানো’ রা বুঝে।

কবি জয়ন্ত জিল্লুর – সাকিয়া সিরিজ কাব্যগ্রন্থটি সাধারণ পাণ্ডুলিপির চেয়ে ভিন্নআকৃতিতে সাজানো। বইটির প্রকাশক আলী প্রয়াস, অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ সালে প্রকাশিত। এ গ্রন্থে মোট ৩৪ টি কবিতার জমিন চাষ। এক একটি কবিতা – এক একটি কাহিনী, রুপক চিন্তা ও ঘটনাবলির দারুণ নিবাস।” সাকিয়া সিরিজ”বইটির হস্ত- কলমে বাধাইকৃত একটি সাহিত্যের নন্দন। তাঁর লেখা কাব্যে যেমন আলাদা বৈশিষ্ট্য, ঠিক তেমনি হাতের কারিশমাও মগজের চেয়ে এগিয়ে। তাঁর কবিতা আমাকে চিন্তার বিষ্ফোরণ করেছে, ভাবুকতায় আচ্ছন্ন করেছে এবং তিশির শতক থেকে শুরু এই দশকের অনেক কবির মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য, ভাবধারা, গঠনকৌশল ও উপলদ্ধির মিল না থাকলেও বাক্যবিন্যাসে অপার শিল্প। প্রতীক ও রুপকের মিশ্রিত আলে রুয়েছে – ব্যতিক্রম ভাব। শব্দের মূলে কাম ও প্রেম নিহিত থাকে – অন্তঃলোকে। কিন্ত সাবলীল তা তারঁ কবিতার আর্কষণ। যেমন- সাকিয়া সিরিজের ২৫ নং কবিতা পড়ুন —
সাকিয়া,
আসুন পাশাপাশি শুয়ে থাকি
যেভাবে রেললাইন শুয়ে থাকে মফস্বলে।
( পৃ/ ৩৫)

কবিতা যে লাইন বাই লাইন সাজিয়ে লিখতে হয়। মনের আবেগ ও নিজস্ব চিন্তা বহিঃপ্রকাশ কে ছোট বা বড় লিখতে হবে এমন নয়।সাকিয়া সিরিজের অধিকাংশ কবিতা গদ্য ঢঙের। চমৎকার ভাবে গল্পের মত করে কিভাবে যে কবিতার শিল্পের বাক সাজিয়েছেন, তা কবি জয়ন্ত জিল্লুর লেখার প্রভাব খুব ভারী। শান্ত জলের মত নীরবচারী হয়ে – ভাবের ছন্দে খই ফুটেছেন। এবার পড়ুন ” সাকিয়া সিরিজ ” এবং ২৮ নং কবিতার সামান্য অংশ—

স্পর্শ আয়নার মতো। নিজেকে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ভেজা চুল থেকে উড়ে যাচ্ছে গন্ধের সারস। কানের লতি থেকে চিঠির মতো আসছে ঠাণ্ডা। চিবুকে আলোড়ন। কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে। পৃথিবীশুদ্ধ স্থির। রহস্য জমা পড়ছে হাতে, রহস্য জমা পড়ছে বুকে। উতোম। মায়াসভ্যতা। বৃষ্টির মতো নামছে সুখ চলছে সুখের ট্রেন। মৌ- মৌ গন্ধ।ভেজা-ভেজা গন্ধ। ঘ্রাণ। রহস্যের দরজা খুলে গের।যেন বেহেশত। চুলের মতো বৃষ্টি এল। নিঃশ্বাস এল।
( পৃ/ ৩৮)
কবির কাব্যের গভীর রহস্যময়, গভীরের টান ও ঝর্ণার মতো ঝরে পরা স্বচ্ছ সুন্দর। তাঁর কবিতা যে সমসাময়িক দের ছেড়ে – বিগত কবিদের ধারায় নিজেকে বদলেছেন। তা হচ্ছে তার – বাংলা কাব্য সাহিত্য স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব।কবি জিল্লুর যে কোন অস্থিরতা নেই, সময়ের সাথে উন্নত চিন্তার আত্মগরিমার সরল- স্বাদুতা আছে। তাই তো বলি – যার যত জ্ঞান তার তত গহীনের বাস। সত্যিই জ্ঞানের বিকাশ, সবখানেই অস্তিত্ব জানান দেয়, তা তাঁকে পড়ে আমি বুঝেছি। তিনি সাহিত্য – শিল্পের কাছে দায়বন্ধ, মুক্তমনা গঠনমূলক কবিসত্তা তাঁকে চিরকাল বেঁচে রাখবেন। তিনি কবিতা চাষ করেন – গ্রামীণ চৈতন্যে, কল্পনা সাজান বিনীত আকরে, শব্দ গাঁথেন মেদবর্জিত এবং চিত্রপট ভাবের নির্যাস।
কবি জয়ন্ত জিল্লু বাংলা সাহিত্য কালের তালে জায়গা বসবেন – আমি নিশ্চিত। সত্যিকারের কাব্য সাধকের জ্ঞান, মহত্ত্ব ও নৈতিকতা যার থাকে, তিনি উত্তমের পাশে বসবাস করে। কারণ যিনি মাথা নত করতে জানেন না, তিনি সবসময় মাথার মুকুট পরে থাকেন, চরিত্র, ব্যক্তি্ত্ব ও মানবিক গুণাবলীর। কবি জয়ন্ত জিল্লুকে শতভাগ পাঠে উদ্ধার করা সহজ ব্যাপার নয়, সেটি কেউ পারে না। আমি না। তবুও চেষ্টা করেছি – নিজেকে তাঁর ভেতরকার বাউলপনাকে মুক্তমনে আকাশে উড়িয়ে দিতে। হয়ত, সেটি অনেকেই হাস্যকর ভাববে। কবি জয়ন্ত জিল্লুর কবিতার বহর আরও বড় হোক, সাহিত্য তাঁর সামিয়ানার তলে নবীনেরা ছায়া পাক, প্রবীণেরা প্রশংসায় ভেসে যাক।

লেখক: কবি ও গদ্যকার।