আহমদ মমতাজঃ  একজন বিশুদ্ধ ইতিহাসবিদ

 আ ফ ম বোরহান

 ইতিহাসের নিয়মেই একজন ইতিহাস বোদ্ধা ও গবেষক আহমেদ মমতাজকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে। জগতের মহামারীর থাবা হরন করেছে অনেক বিদগ্ধজনের প্রাণ। ইতিহাসের প্রয়োজনেই পৃথিবীতে আরো কিছুদিন প্রয়োজন ছিল আহমদ মমতাজকে। তিনি যে ভাবে বিচরণ করেছেন ইতিহাসের প্রতিটি পরতে পরতে অবলীলায়।  তাঁকে বলা হতো বহুমাত্রিক লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক, সাংবাদিকও বটে। মাত্র ৬১ বছর বয়সে তিনি ইতিহাসের নবতর পাতায় সংযোজিত হলেন বিশ্বব্যাপী মহামারীর এক ঝাপটায়। যিনি ভাবতেন মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, বাংলা ও বাঙালিপনা। তাঁর ব্যাপকত্ব, বিশালত্ব, তাঁর কর্ম ও সৃষ্টি এবং অক্লান্ত প্রয়াস- এসব কোন কিছুই সহজে বিশ্লেষণ করার মতো নয়। গবেষণার জ্বালা তিনি সইতে পারতেন  আরাম-আয়েশে।

আমার সৌভাগ্য যে, আমি এই আমর্ম ভূমিলগ্ন, বিনয় ও নম্রতার প্রতিমুর্তি, বিশুদ্ধ জ্ঞানতাপসের অকৃতিম স্নেহ, সান্নিধ্য ও শুভাশিষ পেয়েছিলাম। ২০০১ সাল থেকেই চট্টগ্রাম জার্নালিস্ট ফোরাম- ঢাকা’র নির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে এই জ্ঞানতাপস ইতিহাসবিদের সহচার্যে আসি। চট্টগ্রাম ফোরামের সব অনুষ্ঠানে ছিলো তাঁর সরব উপস্থিতি। আপাদমস্তক ভদ্রলোক কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ। মুখে লেপটে থাকতো মুচকি হাসির  চাদর। ডেকে কাছে বসিয়ে খবর নিতেন যা কিছু। পরে ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা’র জীবন সদস্য লাভ করলে তাঁর সাথে আরও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অতঃপর নয়াপল্টনের হেল্পলাইন রিসোর্স এ আমাদের সখ্যতার খই ফোটে। এখানে মুলতঃ চট্টগ্রাম সমিতি -ঢাকা’র প্রকাশনা ‘চট্টলা’র প্রকাশনার কাজ হতো, সে সময়  আমি হেলপলাইন রিসোর্সের সাথে যুক্ত ছিলাম।  তখন তিনি চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা’র প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের গুরুদায়িত্বে। আমি বাংলা ভাষাতত্ত্বের ক্ষণিক জ্ঞান তাঁর কাছ থেকেই আহরণ করেছিলাম। যদিও অনেক আগে থেকেই তাঁর নাম জানতাম। আমি তাঁর লেখাগুলো পড়তাম মনোযোগ সহকারে। তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তার পরিমাপ ও ব্যপ্তি মাপা অধমের অসাধ্য। একেবারেই প্রচার বিমুখ, আত্মলোপী, সলজ্জ্ব স্বভাবের একজন কর্মঅন্তপ্রাণ মানুষ। সারাটা জীবন জ্ঞানচর্চার নানান বিচিত্র প্রকল্প ও উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে বড় মমতায় জড়িয়ে রেখেছিলেন।

জন্মঃ

এই মহৎ প্রয়াণ মানুষটির জন্ম হয় ১৯৬০ সালের ৩০ জুন, মৃত্যু হয় ২০২১ সালের ৯মে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত পীর বংশে। তাঁর বাবা আব্দুল বারী, মাতা আমেনা খাতুন, দাদা শিকারী হাজী শমসের আলী পাহলোয়ান, নানা ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, তাঁর স্নেহের ছোট ভাইয়ের নাম মানিক। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় উপজেলা মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলি নগর গ্রামে।

শিক্ষা জীবনঃ

আহমদ মমতাজের শিক্ষা জীবন শুরু হয় সে অজপাড়া গাঁয়ে, আমজাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পশ্চিম অলি নগর জুনিয়র হাই স্কুল ও করেরহাট কে এম হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। দক্ষিণ বল্লভরপুর হাই স্কুল থেকে ১৯৭৬ সালে এসএসসি, বারইয়ারহাট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন, ১৯৮২ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে।

কর্মজীবনঃ

আহমদ মমতাজের কর্মজীবন অতি সংক্ষিপ্ত ছিল। পড়ালেখা শেষ করে তিনি নিজ গ্রামের অলি নগর এল বি হাই স্কুলে বেশ কিছুদিন খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে চাকরি করলেও মন পড়ে থাকতো সাহিত্যকর্মে। ১৯৯০ সালে ব্যাংকের চাকুরী থেকে ইত্তাফা দেন। অতঃপর মনন ও মানসিকতার উম্মেষ ঘটিয়ে  যুক্ত হন মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সাথে। যে শিল্প তাঁকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিল পরম মমতায়।

সামাজিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রমঃ

আহমদ মমতাজ-এর বিচরণ ছিল সমাজের নানান দিকে। জাতীয় অংশগ্রহণ মূলক কর্মকান্ডে। পেশাগত আদর্শিক সংগঠনের সাথে। এই তালিকায় তিনি জড়িত ছিলেন মিরসরাই সমিতি, মিরসরাই ইয়ুথ ফোরাম, মিরসরাই এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ, বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ইতিহাস একাডেমি, ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম, চট্টগ্রাম একাডেমী পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, আন্তর্জাতিক লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম জার্নালিস্ট ফোরাম-ঢাকা, মিরসরাই প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র জীবন  সদস্য হয়ে  কাজ করে গেছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থঃ

গবেষক কলামিস্ট আহমদ মমতাজ-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক ছয় শতাধিক প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ হলোঃ মুক্তিযুদ্ধে কিশোর ইতিহাস, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, মিরসরাইয়ের ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি, শমসের গাজী, চট্টগ্রামের সুফি সাধক ও বদর শাহ, চট্টগ্রামের মনীষীদের জীবন বৃত্তান্ত সংকলন, চট্টগ্রাম মনীষী, এছাড়া তাঁর যোগ্য সহধর্মীনী রাইহান নাসরিনের সাথে যৌথভাবে প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশে কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি, বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামী, পলাশী থেকে ঢাকা, বিনোদ বিহারী চৌধুরী।

গবেষণা ও লেখালেখিঃ

দেশ ও জাতির প্রয়োজন তাঁকে খুব বেশি টানে  প্রভাব সঞ্চারী সাহিত্য ও গবেষণা পেশায়। তিনি ছিলেন ইতিহাসের চলন্ত অভিধান। এ কাজে তাঁর স্পষ্টবাদীতা তাঁকে আরো অনন্য করে তুলেছিল। বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি জাতির পক্ষে তাঁকে ভুলে থাকা অসম্ভব। বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সীমানা তিনি বিচরণ করেছেন স্ত্রী সুলেখক রাইহান নাসরিনকে সঙ্গী করে। তাঁর অসাধারণ গতিশীল লেখা  তথ্য ভারাক্রান্ত হতো না, এমনই জাদু ছিল তাঁর ভাষার উপস্থাপনায়, পান্ডুলিপি, টীকাভাষ্য,নির্ঘন্ট,পরিশিষ্ট জাতীয় শব্দাবলীর। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়ায়( দ্বিতীয় সংস্করণ) বারটির বেশী ভূক্তি ও বাংলাদেশ সংস্কৃতিক সমীক্ষা ২০০৭ এর (নবম খন্ড) সাথে যুক্ত ছিলেন।

আহমদ মমতাজ আশির দশক থেকেই চট্টগ্রামের ইতিহাস সহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর নিজ এলাকার মিরসরাইয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা কর্মে মনোনিবেশ করেন ১৯৮০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকাকালীন চট্টগ্রামের অধীনালুপ্ত দৈনিক নয়া বাংলা ও দৈনিক জামানা পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। তখন চট্টগ্রাম কলেজ বাংলা সংসদ, সৈকত সাহিত্য পরিষদ ও ইদানিং সাহিত্য পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন। এ সময় কলেজের স্মরণিকা ও দেয়ালিকা নিয়মিত লিখতেন। এই বর্ষিয়ান গবেষক সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থেকে কলম চালিয়েছেন অবলীলায়। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দশদিশা পত্রিকায় বিভাগীয় ও নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সাল থেকে দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চের ও দৈনিক আজাদীর নিয়মিত লেখক ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা কলম-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ছিলেন। এবং দৈনিক আজকাল পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখক ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা রাজ্য ও চাকলা রোশনাবাদের শাসক শমসের গাজীর জীবন ও কীর্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন ও বই লিখেন। তিনি দেশের গ্রামীন লোকসাহিত্য ও ইতিহাস সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নিরলসভাবে গবেষণা করে গেছেন। সর্বশেষ তিনি আমৃত্যু চট্টগ্রাম পরিক্রমা নামে একটি গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। যা এখন তাঁর স্ত্রী রাইহান নাসরিন প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁর অনেক অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি এখন তাঁর স্ত্রী প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন।

উপসংহারঃ

আহমদ মমতাজ ঢাকায় জীবন কাটালেও দেশ  প্রেম তাঁকে সব সময় গ্রামীণ জনপদের দিকে টেনেছে। ইতিহাস গবেষণায় তাঁর উৎসাহ দেখে  প্রফেসর ডঃ আব্দুল করিম তাঁকে ইতিহাস গবেষণার ছবক দেন।

চাটগাঁর বেলা বিস্কুটের ২০০ বছর, বোস্তামী কাছিম কিংবা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলী খেলার ইতিহাস জানতে চাইলে তো আহমদ মমতাজ-এর বিকল্প নেই। তিনি পেশাগত কারণে মুদ্রণশৈলী ভালো বুঝতেন। তাঁর মাপের একজন ইতিহাস গবেষক বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন এটা আমাদের গৌরব। জহুরী যেমন জহুর চিনে তেমনি বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান স্যার তাঁকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি আহমদ মমতাজকে বাংলা একাডেমীর উপ-পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার হয়েছিলেন। আহমদ মমতাজের অকাল প্রয়াণ হলেও দীর্ঘ ৪০ বছরের গবেষণাকেন্দ্রিক পথচলায় একটুর জন্যও থেমে থাকেননি। সঙ্গিনী রায়হান নাসরিনকে নিয়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে তিনি এসেছিলেন স্বস্ত্রীক আমার দলিজায়। বলেছিলেন আগামীর কর্ম পরিকল্পনা। চট্টগ্রামকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ইতিহাসের এক্কেবারে গহীন গভীরে। তা আর হলো কই।

এখন সময় আহমদ মমতাজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়নের, গবেষণায় একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদকের হকদার  তিনি। দাবি করছি  মিরসরাইয়ের অন্তত একটি সড়ক কিংবা একটি কমিউনিটি হল তাঁর নামে করা হউক।  আহমদ মমতাজের নামের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক অলিখিত ইতিহাস, অনেক ঐতিহাসিক গৌরব গাঁথা। তাঁর অকাল প্রয়াণ এমন একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। যার জন্য আমরা কেউ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। গ্রামীণ সাহিত্যের এত ইতিহাস তাঁর স্মৃতিতে জমে আছে, যা তাঁর কাছে না শুনলে বুঝা যেত না। তাঁর জীবন প্রত্যয় ও সাফল্য আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকবে অনাদিকাল পর্যন্ত।